sayeed

তীব্র তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টিতে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় শঙ্কা

খুলনায় ৬৫ হাজার ৫৩৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ

প্রাণের খুলনা রিপোর্ট

বোরো মৌসুম থেকেই দেশের ধান উৎপাদনের সবচেয়ে বড় জোগান আসে। বলা যায়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে বোরোর উৎপাদন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু এবার দেশের কোথাও-কোথাও তীব্র তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টি বোরোর বাম্পার ফলন তো দূরের কথা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।



বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) জানিয়েছে, দেশে এবার বোরোর উৎপাদন ভালো হয়েছে। কিন্তু তাপপ্রবাহের জন্য কিছু-কিছু জায়গায় সমস্যা হতে পারে। ধানে চিটা হতে পারে। এ অবস্থায় তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে ধান রক্ষায় কৃষককে আগাম পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জমিতে যেন কোনোভাবেই পানির ঘাটতি না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। কারণ, একদিকে তাপমাত্রা বেশি। অন্যদিকে বৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে ব্লাস্টের ঝুঁকি রয়েছে।


এ মৌসুমে মহানগরীসহ খুলনার ৯ উপজেলায় ৬৫ হাজার ৫৩৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। অধিক লাভের আশায় এ অঞ্চলের কৃষকেরা সিংহ ভাগ জমিতে হাইব্রিড বীজের চাষাবাদ করে। সবচেয়ে আবাদ হয়েছে ডুমুরিয়া উপজেলায়। এখানে বোরো আবাদের পরিধি ২১ হাজার ৫৫৮ হেক্টর। এছাড়া তেরখাদা উপজেলায় ৮ হাজার ৯৪৯ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। এ মৌসুমে জেলায় ৩ লাখ ৮ হাজার ৯৯৪ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে। গেল মৌসুমে ৬৪ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৬০ মেট্রিক টন উৎপাদন হয় এ জেলায়। এ তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের।


তেরখাদার আজগড়া, কালিনগর, ছাগলাদহ, নিশিপুর, কোলা, ইছামতি, নয়বারাসাত, কয়রার আমাদি, বেদকাশিতে লবনাক্ত এলাকায় ব্রি-১০৫, বিনা-২৫, হীরা-১, ২, ১৯, এসএল ৮, ময়না, ব্রি ধান- ৮৮ জাতের ধানের চাষ হয়েছে। দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটার একাংশে ৬৫ শতাংশ জমিতে লবণ সহনশীল হাইব্রিড জাতের আবাদ হয়।


সূত্রমতে, বীজ, ইউরিয়া, ডিএপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা, জৈব সার, কীটনাশক, জমির ভাড়া এবং কৃষি শ্রমিক, বীজতলা থেকে ধান কাটা পর্যন্ত একর প্রতি এ মৌসুমে উৎপাদন খরচ হয় ৯০ হাজার ৯৫৭ টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ তথ্যের সাথে আবাদি কৃষক দ্বিমত পোষণ করেছেন।


খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম জানান, বীজ, সার ও কৃষি শ্রমিকের মূল্য বাড়ার কারনে এবারের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। জেলায় ৬ শতাংশ জমির বোরো কাটা হয়েছে। আগাম আবাদ করা উপজেলাগুলো হচ্ছে পাইকগাছা, কয়রা, ডুমুরিয়া ও তেরখাদা। তিনি বলেন, সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত প্রতিদিন জনপ্রতি রোপণের সময় মজুরি ছিল ৬০০ টাকা। দাবদাহের কারণে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বাড়তে পারে।


তেরখাদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিউলী মজুমদার জানান, হাড়িখালি, আজুগড়া, মধুপুর, সাচিয়াদহ ও ছাগলাদহে উৎপাদন আশানুরুপ হবে। সেচ সংকট হয়নি। দু’এক জায়গায় পোকার আক্রমণ হলেও কৃষক তা সহজেই দমন করেছে। কৃষি মজুরি বাড়ার কারণে এবার উৎপাদন খরচ বেড়েছে।


ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া এলাকার কৃষক হানিফ মোড়ল ৫ একর জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। তার দেওয়া তথ্য মতে, বিঘা প্রতি উৎপাদন হবে ১৫ হাজার টাকা। রোপণের সময় জনপ্রতি প্রতিদিনের কৃষি মজুরি ছিল ৬০০ টাকা। আগামী শুক্রবার থেকে তার আবাদকৃত জমিতে ধান কাটা শুরু হবে। তার ধারণা, ধান কাটার সময় কৃষি শ্রমিকের জনপ্রতি মজুরি ৮০০ টাকা হতে পারে। বিঘা প্রতি ৩০ মণ ধান হলে উৎপাদন খরচের দ্বিগুণ দাম পাবেন বলে তিনি আশাবাদী। এ গ্রামের চাষী মনিরুজ্জামান কাজী এবং মকবুল ইসলাম শেখ উদ্বিগ্ন, বৃষ্টি কিংবা তাপমাত্রা বাড়লে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বাড়তে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আশানুরুপ ফলন হবে বলে তারা আশাবাদী।


গেল বছর বোরো কাটার শুরুতেই বটিয়াঘাটার কৈয়া, বটিয়াঘাটা সদর ও দাকোপের চালনা বাজারে নতুন ধান ১ হাজার মণ দরে বিক্রি হয়। ২০২২ সালের করোনার ধাক্কা সামাল দেওয়ার পর এই প্রথম কৃষক লাভের মুখ দেখে। আমন মৌসুমে অক্টোবরে অতিবৃষ্টির কারণে ডুমুরিয়া, পাইকগাছা ও রূপসার কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।


তবে এ পরিস্থিতির মধ্যেও স্বস্তির বিষয় রয়েছে। সরেজমিনে নেত্রকোনার বিভিন্ন হাওরাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হাওরের বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে আগাম জাতের বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। দ্রুত এই ধান ঘরে তুলতে পারলে বিরূপ আবহাওয়া থেকে হাওরের ধান রক্ষা করা সম্ভব হবে। এছাড়া, উত্তরাঞ্চলে অধিকাংশ জমির  ধান ফুলে বেরিয়েছে। ধানের চেহারা বেশ ভালো। তবে এ সময় বৃষ্টি হলে আবাদ নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কার মধ্যে থাকতে হতো না বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম। তবে চলতি এপ্রিল মাসের দুই-একদিনের মধ্যে আবার ১৭/১৮ তারিখের দিকেও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ বৃষ্টি হলে রোগবালাইয়ের হাত থেকেও বোরো রক্ষা পাবে। কারণ, ইতিমধ্যে যশোর জেলায় সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া, ৪০টি জেলায় মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। আমাদের নেত্রকোনা প্রতিনিধি শ্যামলেন্দু পাল ও খালিয়াজুরী প্রতিনিধি মহসিন মিয়া জানিয়েছেন, নেত্রকোনা জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে পাঁচটি হাওর উপজেলায় বোরো ধান কাটা আংশিকভাবে শুরু হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে পুরো দমে বোরো ধান কাটা শুরু হবে। বর্তমানে যে হারে বোরো জমিগুলো রোদ পাচ্ছে তাতে ফলনও ভালো হবে। তবে একটা বৃষ্টি হলে আরও ভালো হত বলে কৃষকরা জানান।  জেলার মদন ও খালিয়াজুরীর রসুলপুর, জগন্নাথপুর, মদনের গোবিন্দশ্রীসহ কয়েকটি হাওর এলাকা পরিদর্শনে দেখা গেছে, কৃষকরা পাকা ধান কাটা শুরু করেছেন। মদন উপজেলার বৃ-বড়িকান্দি গ্রামের কৃষক সাদেক মিয়া, বিধান আদিত্য, পলাশ মিয়া এবং মোখলেস মিয়া বলেন, এবার বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তারা পাকা ধান কাটা শুরু করেছেন। যদি বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না আসে তাহলে তারা তাদের জমির সব ধান ঘরে তুলতে পারবেন।


রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা দীপক কুমার কর জানিয়েছেন, এই এলাকার অধিকাংশ জমির ধান ফুলে বেরিয়েছে। ধানের চেহারা খু্ব ভালো। কোন ঝড়-ঝামেলা না হলে ভালো ফলনের আশা করছেন স্থানীয় কৃষকরা।  তারা বলেছেন, ২০/২৫ দিনের মধ্যেই ধান কাটা শুরু করবেন তারা। উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের চান্দাইকোনা পূর্বপাড়া গ্রামের কৃষক পল্টন কুমার বলেন, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে শোভনলতা ধানের চাষ করেছেন। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় সেচ বেশি দিতে হচ্ছে বলে তিনি জানান।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য বলছে, ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে এবার বোরো আবাদ হয়েছে। আর বোরো ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টন। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৪৬ টন। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে বোরোর উৎপাদন ছিল ২ কোটি ১০ লাখ টন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৭ লাখ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি ১ লাখ টন ও ২০২০-২১ অর্থবছর ১ কোটি ৯৮ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়। এদিকে সম্প্রতি দেশে চাল উৎপাদন পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার (ইউএসডিএ)। সংস্থাটির বৈদেশিক কৃষিসেবা বিভাগের (এফএএস) ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাগ্রিকালচারাল প্রডাকশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ধানের আবাদ কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে এবার চালের উত্পাদন ৪ লাখ টন কমতে পারে। এ প্রসঙ্গে ব্রির মহাপরিচালক কৃষি বিজ্ঞানি ড. খালেকুজ্জামান বলেন, দেশের এবার ধানের আবাদ কম হচ্ছে। এই তথ্য তারা কোথা থেকে পেয়েছে বলতে পারছি না। তবে উৎপাদন কম হতে পারে—এটা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ, তাপমাত্রা ও অনাবৃষ্টির কারণে আমরা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছি। কিন্তু এমন তো হতে পারে আমাদের শঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে।

Comments

sayeed

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ