প্রাণের খুলনা রিপোর্ট
এরশাদ শিকদারের অধ্যায় ২০০৪ সালে ফাসির মধ্যদিয়ে শেষ হয়। তার নির্মমতার কথা খুলনার মানুষ কোনোদিনও ভুলবে না। দীর্ঘদিন আলোচনায় না থাকলেও আবার আলোচনায় এসেছে। তবে এবারের দৃশ্যপটে এরশাদ সিকদারের ম্যানেজার মুজিবর রহমান শামিম। এরশাদের আটকের পর তার অধিকাংশ অর্থ-সম্পত্তি ছিল এই শামিমের নিয়ন্ত্রণে। সিকদার গ্রেফতারের পর কয়েক বছর গা ঢাকা দিয়ে থাকেন তিনি।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাত মেলান শেখ হেলালের সাথে। সিকদারের সম্পত্তিতে রাতারাতি বনে যান শিল্পপতি। এখানেই থেমে গেলে হয়তো সব ঝামেলা শেষ হয়ে চুকে যেত। কিন্তু সিকাদারকে ছেড়ে আসলেও পারে নি অন্ধকারের সেই অপরাধ জগত থেকে ফিরতে। নতুন করে শুরু করেন প্রতারণা। শেখ হেলালের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। ছাত্র জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাগেরহাট জেলার চিতলমারীর সন্তোষপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এই মুজিবর রহমান শামিম। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত চিতলমারী উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সন্তোষপুর ইউনিয়ন যুবলীগের দায়িত্ব পালন করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতিতে না জড়ালেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। শেখ হেলালের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ২ বার এমপি পদপ্রার্থী হতে চাইলেও মনোনয়ন পান নি। সংসদ সদস্য হতে না পারলেও নিজের স্ত্রী সামিয়া রহমান বিউটির জন্য বাগিয়ে নিয়েছিলেন চিতলমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ।
২০১৯ সালের এপ্রিলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে প্রবেশের সময় তাকে আটক করেছিল সিভিল এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স। সে সময় তিনি চিতলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন বলে জানা যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন তৎকালীন এভসেক পরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী।
মুজিবর রহমান শামিমের অপরাধের মূল কেন্দ্র ছিল ব্যাংক লুট। আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সে সময় তিনি নামে-বেনামে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা লুট করেন। হাতে পাওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের নথিপত্র থেকে যাচাই করে দেখা যায় শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংক ট্রাষ্ট, পদ্মা ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে এখনো সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি রয়েছে এই মুজিবরের। একই সম্পত্তির নামে আকাধিকবার লোন ও নিজ সম্পত্তি দেখিয়ে লোন ছাড়াও বিক্রি করা সম্পত্তি দেখিয়েও লোন নিয়েছেন তিনি। মুজিবর রহমান শামিমের প্রতিষ্ঠান সাউথ হ্যাচারী এন্ড এগ্রো লিমিটেডকে বিভিন্ন ব্যাংকে জামানত রেখে নিয়ম বহির্ভুত লোন নিয়েছেন তিনি। এছাড়াও জয় শিপিং নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ট্রাষ্ট ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছেন তিনি। অথচ এই জয় শিপিং নামক প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা তিনি বিক্রি করেছেন আরো ২ বছর আগে। বিষয়টি জানার পরও মুজিবরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় নি ট্রাষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ট্রাষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের দুর্নীতি ঢাকতে মুজিবরের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান সাউথ এগ্রোকে ঋণ খেলাপির দায়ে নিলামে তোলার জন্য একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ব্যাংক মালিকের সাথে সখ্যতা থাকায় ঐ বিজ্ঞাপন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকেছিল ব্যাংকটির খুলনা শাখার কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম। এতসব লুটপাটের পরেও তার কিছুই হয়নি। কারণ তার মাথায় ছিল শেখ হেলালের হাত।
২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী সরকারের ক্ষমতাচ্যুতের পর শেখ হেলালের সাথে পালিয়ে যায় মুজিবর। মাস ৩ গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর নিজের বেশ পাল্টে হাজির হয়েছেন নতুন রূপে। দাড়ি-টুপি লাগিয়ে চেষ্টা চালিয়েছেন জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হবার। জামায়াতের সবুজ সংকেত না পেয়ে হাতপাখায় যোগ দিয়েই নতুনভাবে শুরু করেছেন পুরাতন প্রতারণা। হাতপাখায় ঢুকেই এই প্রতারক পুনরায় নেমেছেন ব্যাংক লুটে।
১টি গোপন চুক্তিপত্র অনুযায়ী সোস্যাল ইসলামী বাংক তাকে ১০০ কোটি টাকা লোনের মধ্যে ৫০ কোটি টাকা প্রদান করেন। বাকি ৫০ কোটি টাকা ছাড়ের আগেই স্বৈরাচার সরকারের পতন হলেই সেই টাকা আটকে দেয় ব্যাংক। ১৫ মে ২০২৫ সালের ঐ চুক্তিপত্র অনুযায়ী দেখা যায় বাকি ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ছাড়িয়ে আনতে তৃতীয় এক পক্ষকে ৮ কোটি টাকা ঘুষ দিতে সম্মত হয়েছেন এই মুজিবর। এভাবেই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মুজিবর।
বিভিন্ন সময় রং পাল্টানো এই মুজিবর রহমান শামিম ৫ আগস্টের পর দাড়ি-টুপি লাগালেও এখনো আওয়ামী স্টাইলে নিজের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে মুজিবরের মোট ৫টি পাসপোর্টের তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে তার নাম-ঠিকানা এক থাকলেও পাসপোর্ট নাম্বারগুলো ভিন্ন। মুজিবরকে এই একাধিক পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেছে পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগও করেছেন। অভিযোগ পেয়ে দুদক তদন্তে নামার পর তদন্ত কর্মকর্তাকে টাকা দিয়ে কিনতে না পেরে মুজিবর দুদক চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের আবেদন করেছেন।
এখানেই থেমে নেই লেবাসধারী এই আওয়ামী সন্ত্রাসীর। অভিযোগ রয়েছে যে, নিজ জুটমিলের কর্মকর্তাদের নামে মিথ্যা চুরির মামলা দিয়ে হয়রানি করছে এই মামলাবাজ।
ভুক্তভোগী জয় জুট মিলের এক কর্মকর্তা জানান, মিথ্যা কথা বলে তাদের মিলে ডেকে নিয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে মারপিট করে জোরপূর্বক সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন জয় জুট মিলের চেয়ারম্যান প্রতারক এই মুজিবর। আমরা যখন কথা বলা শুরু করি। তার কিছুক্ষণ পরই তিনি বলেন, আমার বাইরে একজন মেহমান এসেছে, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। উনি বাইরে চলে যাওয়ার সাথে-সাথেই ওখানে পূর্বে থেকে অবস্থান করা মোদাচ্ছের মেম্বর, নূর ইসলাম এবং লিটনসহ আরো ৪/৫ জন আসে আমাদের টর্চার করার জন্য।
Comments
Post a Comment